Advertisement
Google search engine

পারিবারিক পাঁচটি সমস্যা নিয়ে এ আদালতে মামলা দায়ের করা যায়। বিবাহবিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, খোরপোশ, শিশুসন্তানের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান। এই আদালতের উদ্দেশ্য হলো অল্প খরচে ও অল্প সময়ে নারীদের অধিকার দ্রম্নত নিষ্পত্তি করা।

জেলা জজকোর্টে প্রতিটি উপজেলার জন্য একটি করে পারিবারিক আদালত আছে। এই আদালতের প্রধান একজন সহকারী জজ। তবে বিচার শুরু করার আগে পারিবারিক আদালতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আপস-মীমাংসার চেষ্টা করা। যদি আপস-মীমাংসার চেষ্টা ব্যর্থ হয় তবে আদালত তার বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। এই বিচার ওপেন কোর্টেও হতে পারে আবার রুদ্ধদ্বার কক্ষেও হতে পারে। যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালত লিখিত রায় ও ডিক্রি দেবেন।

আদালত ডিক্রির টাকা যে কোনোভাবে পরিশোধের আদেশ দিতে পারেন (কিস্তির মাধ্যমেও)। (৪৯ ডিএলআর, ৫৭)। তবে দায়িক কিস্তির মাধ্যমে টাকা পরিশোধের দাবি করতে পারে না; কিন্তু আদালত দিতে পারে। (৫২ ডিএলআর, ১৫৮)। আদালত ডিক্রির টাকা অনাদায়ে বিবাদীকে ৩ মাস বা টাকা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত কারাদন্ড দিতে পারেন। সংক্ষুব্ধ পক্ষ ইচ্ছা করলে আদালতের রায়, ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে জেলা জজের আদালতে আপিল করতে পারবেন। তবে মোহরানা ৫০০০ টাকার বেশি না হলে কোনো আপিল করা যাবে না।

উলেস্নখ্য, পারিবারিক আদালতের কোনো রায়ের বিরুদ্ধে রিভিশন করা যাবে না, আপিল করা যাবে। তবে আপিল আদালত পারিবারিক আদালতের মামলায় রিমান্ডিংয়ের আদেশ দেবেন না। (৫২ ডিএলআর ৪৫৩)।

উলেস্নখ্য, বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। কেউ যদি পারিবারিক আদালত অবমাননার দায়ে (ধারা ১৯) দোষী হয় তবে আদালত তার জরিমানা করতে পারেন যা ২০০ টাকার বেশি হবে না। সমস্যা যে জেলায় উদ্ভব হয় সেই জেলার পারিবারিক আদালতে বা স্বামী-স্ত্রী সর্বশেষ যে জেলায় বসবাস করেন সেই জেলার আদালতে বা স্ত্রী যে জেলায় বসবাস করছেন সেই জেলার পারিবারিক আদালতে মামলা করা যাবে।

পারিবারিক আদালতে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে কয়েকটি ধারাবাহিক স্তর অতিক্রম করতে হয়। যেমন- মামলা দায়ের করতে হয় আর্জি দাখিলের মাধ্যমে। আর্জিতে বেশ কিছু বিষয় সন্নিবেশিত করতে হয়। যেমন- ১. যে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা হবে, সে আদালতের নাম, ২. বাদীর নাম, বিস্তারিত বর্ণনা ও বাসস্থানের ঠিকানা, ৩. বিবাদীর নাম, বিস্তারিত বর্ণনা ও বাসস্থানের ঠিকানা, ৪. যে ক্ষেত্রে বাদী বা বিবাদী নাবালক বা অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তি হয়, সে ক্ষেত্রে তার পক্ষে প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তির বিবরণ, ৫. নালিশের কারণ এবং যে স্থানে ও যে তারিখে ঘটনাটি ঘটেছিল সে স্থান ও তারিখ যেসব তথ্যের ওপর আদালতের যথার্থ এখতিয়ার রয়েছে, ৬. মোকদ্দমার মূল্যমান ও ৭. বাদীর প্রার্থিত প্রতিকার।

অধিকার আদায়ের সর্বশেষ অবলম্বন হিসেবে ভুক্তভোগী আশ্রয় নেন পারিবারিক আদালতে। কিন্তু সেখানে রয়েছে আদালতের দীর্ঘসূত্রতা, মামলা চালানোর অর্থাভাব, অন্যপক্ষ থেকে মানসিক চাপ। সেই সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় তাদের আদালতযোগে সমন পাঠানো হলেও সমন জারিকারকদের উদাসীনতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে যথাসময়ে সমন জারি হয় না। ফলে বিচারকাজ শুরু হতে অযথাই দেরি হয়। কখনো আবার ভুক্তভোগীর পক্ষে পারিবারিক আদালত রায় কিংবা ডিক্রি প্রদান করলেও অন্যপক্ষ উচ্চ আদালতে ওই ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করে। এতে আবেদনকারীর প্রাপ্য অধিকার দীর্ঘসূত্রতার জালে আবদ্ধ হয়। ফলে পারিবারিক আদালতে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার প্রক্রিয়ার সনাতন পদ্ধতিগুলোর আধুনিক সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

আইনজীবী ও বিচারকসহ আদালত সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ধরনের মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও আন্তরিক ও যত্নবান হওয়া উচিত। বিলম্বিত বিচারপ্রক্রিয়া, যথাসময়ে সমন জারি না হওয়া এবং পারিবারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে বছরের পর বছর ধরে আপিল-মামলা ঝুলে থাকা কিংবা অন্য কোনো জটিলতার কারণে ভুক্তভোগীরা পারিবারিক আদালতে আশ্রয় গ্রহণ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেললে তা দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা দরকার।

এছাড়া আইনটির অধীনে কোন কোন জনগোষ্ঠী আদালতের কাছে পারিবারিক সমস্যা নিয়ে যেতে পারবে কিংবা আইনটি শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্যই কিনা? আইনের এই বিভ্রান্তি পরে অবশ্য আদালতের বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী রায়ের মধ্যদিয়ে নিরসন হয়েছে। যেমন কৃষ্ণপদ তালুকদার বনাম গীতশ্রী তালুকদার (১৪, বিএলডি, ১৯৯৪, ৪১৫) হাইকোর্ট বিভাগ কেবল মুসলিমদের জন্য পারিবারিক আদালতগুলো গঠিত বলে অভিমত দিয়ে বলে, ‘যেহেতু পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫-এর ৫ ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে, পারিবারিক আদালতের এখতিয়ার মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে। তাই একথা বলার আর অবকাশ থাকে না, অধ্যাদেশের ৫ ধারায় যে পাঁচটি বিষয়ে পারিবারিক আদালতের এখতিয়ার আছে, এসব ক্ষেত্রে শুধু মুসলিম প্রার্থীরাই আদালতের কাছে আসতে পারবে।’

নির্মল কান্তি দাস বনাম শ্রীমতী বিভা রানী (১৪, ১৯৯৪, বিএলডি, ৪১৩) মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ সম্পূর্ণ ভিন্ন রায় প্রদান করে। আদালত তার রায়ে বলেন, ৫ ধারায় যাই থাকুক না কেন, ৩ ধারায় কিন্তু এ কথা বলা আছে যে, বাংলাদেশে প্রচলিত- অন্য যে আইনে যে বিধানই থাকুক না কেন, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ প্রাধান্য পাবে। এ থেকে বোঝা যায় মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, ১৯৮৫ সালের অধ্যাদেশের অধীনে থাকবে। তাই এ মামলায় আদালত তার রায়ে বলেন, এই কারণে একজন মুসলমান স্ত্রীর মতো একজন হিন্দু মহিলাও ভরণপোষণের জন্য পারিবারিক আদালতে অবশ্যই মামলা করতে পারবে। এরপর মেহের নিগার বনাম মো. মজিবুর রহমান (১৪, বিএলডি, ১৯৯৪, ৪৬৭) মামলাতেও আদালত একই রকম রায় প্রদান করে।

বিয়ের কাবিননামা খাঁটি, বৈধ, জাল কিংবা নকল কিনা এরকম প্রশ্ন উত্থাপন ছাড়া প্রার্থী ও প্রতিবাদীর মধ্যে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ তাদের দেনমোহর ও ভরণপোষণ প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালত এখতিয়ার সম্পন্ন। অনুরূপ ক্ষেত্রে একই বিষয়ে স্বত্বের মামলার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন নেই; কারণ একথা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না, অনুরূপ মামলাটি কখন নিষ্পত্তি হবে। অধিকন্তু এটা অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। (শফিকুল হক বনাম মিনা বেগম, ৫৪, ডিএলআর, পৃষ্ঠা-৪৮১)।

অন্য একটি মামলায় বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্ন উত্থাপিত না হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক আদালত উক্ত বিষয় নিষ্পত্তি করতে এখতিয়ার সম্পন্ন মর্মে মহামান্য আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। (শাহ আলম বনাম ফরিদা বেগম, ২ এমএলআর (আপিল বিভাগ), পৃষ্ঠা-১৫৩, ২, বিএলসি (আপিল বিভাগ), পৃষ্ঠা-৯২)। কাবিননামা রেজিস্ট্রিকৃত হয়নি এ অজুহাতে বিয়ে অবৈধ ঘোষণা করা যায় না। (১৯৯৮ বিএলডি ৩২৯)। তবে পারিবারিক আদালতে সন্তানের বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন নিষ্পত্তিযোগ্য নহে। (এনএলআর ১৯৯১ সিভিল ৫৪৮)।

তবে পারিবারিক আদালতের একতরফা ডিক্রির বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে সেকশন ৯ (৬) ধারায় ডিক্রি বাতিলের আবেদন করতে পারে। বাদীকে প্রমাণ করতে হবে, একতরফায় হাজির না হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। (পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫)। পারিবারিক আদালতের মামলায় প্রেরিত সমন সেকশন ৭(১)(গ) ধারার বিধান মতে ডাকযোগে জারি করা যায়। জারি অন্তে প্রাপ্তি স্বীকার আদালতে ফেরত এলে বা নিতে অস্বীকার করলে জারি বলে গণ্য হবে। সঠিক ঠিকানায় প্রেরিত হলে ডাকে পাঠানোর তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে প্রাপ্তি স্বীকার ফেরত না এলেও তা জারি বলে গণ্য হবে।

সিরাজ প্রামাণিক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা

Google search engine

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here