বিয়ে আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত ও রাসুল (সা.) এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। ইসলামি শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান বিয়ে। আদর্শ পরিবার গঠন, চারিত্রিক অবক্ষয় রোধ ও ধর্মীয় এবং সামাজিক স্বীকৃতিতে মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণের অনুপম এক হাতিয়ার বিয়ে। মুসলিম আইনে বিবাহের আইনগত গুরুত্ব, সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।
একটি ছেলে ও মেয়ের সংসারধর্ম পালনের লক্ষে, ধর্মীয় ও সামাজিক সুরক্ষা দিতেই বিবাহ প্রথার জন্ম। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে হলো একটি দেওয়ানি চুক্তি (কনট্রাক্টচুয়াল অ্যাগ্রিমেন্ট ফর সিভিল ন্যাচার)।
ইসলাম ধর্মের অন্য কোনো উৎস অথবা বাংলাদেশের প্রচলিত অন্য যেকোনো আইনে যা কিছুই বলা থাকুক না কেন মুসলিম ও পারিবারিক আইনের অধীনে একটি আইনসম্মত নিকাহ বা বিবাহ সম্মাদনের জন্য কয়েকটি শর্ত অবশ্যই পালন করতে হবে।
বাংলাদেশের পারিবারিক আইনের আওতায় মুসলিমদের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক বিধানগুলো মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ (মুসলিম ফ্যামিলি ল অর্ডিনেন্স) অনুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মুসলিম বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯৭৪-এর বিধান অনুযায়ী হয়ে থাকে।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯-এ বলা আছে, বরের বয়স অবশ্যই ২১ বছর এবং কনের বয়স ১৮ বছর হতে হবে। সমাজের যেকোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য যেমন দুইপক্ষকে প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হয়, তেমনি বিয়ের চুক্তি সম্পাদনের জন্য দুই পক্ষকে প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিকের অধিকারী হতে হয়। অন্যথায় সাধারণ চুক্তিরমত এ বিধানটিও আইন সম্মত হবে না। বাতিলযোগ্য হবে।
পক্ষ দুটির সম্মতির ব্যাপারে বলা আছে যে, একটি পক্ষ প্রস্তাব করার পর অপর পক্ষকে স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করতে হবে। বৈধ বিয়ে সম্পাদনের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো সুস্থ মস্তিস্ক ও প্রাপ্তবয়স্ক সম্পন্ন মুসলমানের বিয়ে যদি তার সম্মতি ব্যতিরেকে করা হয়, তাহলে ওই বিয়ে চুক্তিটি বৈধ বিবাহ বলে গণ্য হবে না।
একটি বৈধ বিবাহ সম্পাদনের জন্য বর কনেকে প্রস্তাব দেবে, যাকে ইজাব বলা হয়। আর কনে ওই প্রস্তাবটিতে সম্মতি দিয়ে কবুল বলে গ্রহণ করবে। একটি বৈধ বিবাহ সম্পাদনের ক্ষেত্রে স্বাক্ষীদেরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। হানাফি মত অনুসারে বিয়ের সাক্ষী সম্পর্কে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলার কথা বলা হয়েছে। একজন পুরুষকে একজন পূর্ণ সাক্ষ্য এবং সাক্ষী হিসেবে একজন নারীকে একজন পুরুষের অর্ধেক ধরা হয়েছে।
অর্থাৎ একজন নারী স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্যগুন একজন পুরুষ স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য গুনের অর্ধেক। কিন্তু বাংলাদেশের আইন (স্বাক্ষ্য আইন) অনুযায়ী নারী ও পুরুষ সমান গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। সুতরাং বিয়ের স্বাক্ষী হিসেবে উপস্থিত দুই জনের দুইজন পুরুষ দুইজন নারী অথবা একজন পুরুষ আর একজন নারী হতে পারে।
ইসলামি শরিয়াহ পুরুষের জন্য একসঙ্গে একাধিক বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এটি কিছুতেই শর্তহীন নয়। ভরণপোষণ, আবাসন শয্যাসঙ্গমনের ক্ষেত্রে শতভাগ সমতাবিধান করতে হবে।
হযরত সুলাইমান (আ.)-এর ৯০ জন স্ত্রী ছিলেন। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সময় এমন কিছু ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন যাদের ৮ জন অথবা ৫ জন স্ত্রী ছিলেন। রাসুল (সা.) তাদের ৪ জন স্ত্রী রেখে বাকিদের তালাক দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মুসলিম ও পারিবারিক আইন পরিচিত, মুসলিম পারিবারিক আইন বিধিমালা, মুসলিম বিবাহ তালাক নিবন্ধন আইন ও বিধিমালা, মুসলিম আইন, হ্যান্ড বুক অব মুসলিম ফ্যামিলি ল’ (ডিএলআর), বৈবাহিক আইন পরিচিতি- এসব আইন সমূহে বিশ্লেষণ করলে একজন মুসলিম পুরুষ কোন প্রেক্ষাপটে কতটি বিয়ে করতে পারেন ও বিবাহের ক্ষেত্রে কোন কোন শর্ত পালন করতে হয় সেগুলো তুলে ধরা হলো।
১. পক্ষগণের প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। ছেলেদের ২১ ও মেয়েদের ১৮ বছর বয়স হতে হবে। বাল্য বিবাহ হওয়া যাবে না।
২. পক্ষগণের বিয়েতে সম্মতি থাকতে হবে (ইজাব ও কবুল)। নারীদের জোর করে বিয়েতে বাধ্য করানো যাবে না।
৩. প্রাপ্ত বয়স্ক/বয়স্কা দুইজন স্বাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ে পড়াতে হবে।
৪. দেনমোহর বা মোহরানা নির্ধারণ করতে হবে।
৫. বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করা।
৬. একজন স্ত্রী হয়তো বন্ধা হতে পারে অথবা হতে পারে অসুস্থ হওয়ার কারণে তার সঙ্গে তার স্বামী দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। অথচ একজন স্বামীর সন্তানের আকাঙ্খা থাকতে পারে। এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হলো এক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য একজন নারীকে বিয়ে করা।
৭. এমনটি হতে পারে যে একজন নারী একজন ব্যক্তির আত্মীয়া এবং তার দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই এবং সে একজন অবিবাহিত নারী অথবা একজন বিধবা নারী। ওই নারীর জন্য এটি একটি উত্তম ব্যবস্থা যে, তাকে প্রথম স্ত্রীর পাশাপাশি দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে নিজের পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া যেন সে ওই নারীকে পবিত্র রাখতে পারে। তার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে। তাকে একাকী ছেড়ে দেয়া এবং তার জন্য শুধু অর্থ ব্যয় করার মধ্য নিজেকে সীমাবদ্ধ করার চেয়ে এ পন্থা অধিক উত্তম।
৮. ইসলামী শরিয়ত একটি শক্তিশালী সমাজ কাঠামো দেখতে চায়। এক্ষেত্রে পরিবারগুলোর মধ্যকার বন্ধন শক্তিশালী হওয়ার বৃহত্তর স্বার্থ থাকতে পারে। যেমনটা দেখা যায় মহানবী (সা.) এর জীবনে। তাঁর কোন কোন বিয়ে ছিল এ ধরনের বৈরী লোকদের বংশীয় সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সন্ধী স্থাপনের নিমিত্তে। আর অন্যতম একটি উপায় হলো একাধিক বিয়ে করা।
৯. একজন নারীর প্রতিমাসে ঋতুস্রাব হয় (হায়েজ) হয়। আর যখন তিনি সন্তান প্রসব করেন তখন তার ৪০ দিন রক্তচাপ (নিফাস) হয়। সে সময় একজন পুরুষ তার স্ত্রর সঙ্গে সহবাস করতে পারে না। কেননা হায়েজ ও নিফাসের সময় সহবাস করা হারাম এবং এটি যে ক্ষতিকারক তা মেডিক্যালি প্রমাণিত। তাই ন্যায় বিচার করতে সক্ষম হলে একাধিক বিবাহ করা অনুমোদিত। নারী সব সময় এমন থাকে না যে স্বামী তার সঙ্গে সহাবস্থানে থাকতে পারে। প্রথম কারণ প্রত্যেক নারীর জন্য মাসের কোনো এক সময় এমন অতিবাহিত হয় যখন তাকে পুরুষ থেকে দূরে থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত, গর্ভকালীন অবস্থা। অর্থাৎ নারীকে নিজ ও নিজের সন্তানের স্বাস্থ্য রক্ষার তাগিদে কয়েকমাস ধরে স্বামীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হয়। আবার সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর কয়েকমাস পর্যন্ত দূরে থাকতে হয়। এসব সময় নারীর জন্য কুদরতি প্রক্রিয়ায় স্বামীর সংস্পর্শ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে স্বামীর জন্য স্ত্রীর সংস্পর্শে যেতে কোনো বাধা নিষেধ থাকে না। তখন যদি কোনো পুরুষের কামভাব চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় তাহলে একাধিক স্ত্রী ছাড়া তার জন্য কী-ইবা করার থাকে।
১০. প্রত্যেক দেশেই পুরুষের চেয়ে নারীদের শক্তি দ্রুত বার্ধ্যকের শিকার হয়ে থাকে। যেখানে পুরুষের যৌবন পুরোপুরি অটুট থাকে এবং নারী বুড়ি হয়ে যায়। সেখানে দ্বিতীয় বিয়ে করা এত জরুরি হয়ে দাঁড়ায়, যেমন আগে প্রথম স্ত্রী বিবাহ করা আবশ্যক হয়েছিল। যে আইন একাধিক স্ত্রী নিষিদ্ধ হওয়ার কথা বলে, প্রকারান্তরে সে আইন ওই সব পুরুষকে নিজ কামশক্তি ব্যভিচারের মাধ্যমে প্রয়োগের ইঙ্গিত করে। যাদের যৌন শক্তি সৌভাগ্রক্রমে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত অটুট থাকে এমন আইন কিভাবে সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুকূলে হতে পারে।
ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী একজন পুরুষ একত্রে চারজন নারীকে বিয়ে করতে পারেন। বিয়ের ক্ষেত্রে পূর্বের স্ত্রীর অনুমিত শর্ত না। শক্তি সামর্থ্যবান ব্যাক্তি একসঙ্গে চারজন নারীকে বিয়ে করলে শরীয়াহ মোতাবেক কোনো অসুবিধা নেই। তবে এই পুরুষকে সব স্ত্রীর ক্ষেত্রে ইনসাফও কায়েম করতে হবে। মুসলিম ও পারিবারিক অধ্যাদেশ অনুযায়ী একজন মুসলিম পুরুষ একত্রে ৪ জন স্ত্রীকে রাখতে পারেন। তবে ১ম বিয়ের পর পরবর্তি বিয়েগুলো করার ক্ষেত্রে পুর্বের স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়।